রবিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬

কবে বিশ্ববিবেক জাগ্রত হবে ?


পরিস্থিতির আর কতদূর অবনতি হলে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্মী বর্বরতার অবসান হবে? আর কত মানুষ মারা গেলে বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হবে? আর কত মা বোন ধর্ষিত হলে বিশ্ব শক্তিরা জেগে উঠবে?

 আমারতো মনে হচ্ছে যে ২৫ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানের মধ্যে যে ১৩ লাখ এখনো বার্মার রাখাইন প্রদেশে রয়েছে তারা সকলে একেবারে মাটির সাথে মিশে গেলে তখনই মানবাধিকারের ফেরিওয়ালারা জেগে উঠবে। এতদিন আমরা জবাই করে হত্যা করা অথবা বন্দুক রাইফেলের গুলীতে নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার কথা শুনেছি। কিন্তু সেই নিরীহ নিরস্ত্র মানুষগুলোকে হেলিকপ্টার গানশীপ থেকে অর্থাৎ আকাশ থেকে গুলী করে হত্যার খবর কি আপনারা শুনেছেন? কাদের বিরুদ্ধে আকাশে হেলিকপ্টার থেকে গুলী করা হচ্ছে? যাদের হাতে রাইফেল পিস্তল তো দূরের কথা, একটি লাঠিসোঁটা বা পিস্তল পর্যন্ত নাই? এতদিন আমরা বিভিন্ন দেশে গণহত্যার খবর দেখেছি। কিন্তু যাদেরকে খুন করা হচ্ছে তাদের গলিত লাশ থেকে পচা দুর্গন্ধ বের হওয়ার খবর কি আপনারা শুনেছেন? কোথায় যাবে এই বেচারা রোহিঙ্গারা? সীমান্তের ঐ পারে বর্মী সেনা গুলী করে তাড়িয়ে দিচ্ছে। ওরা নৌকায় করে পালিয়ে প্রাণ বাঁচানোর আশায় নাফ নদী দিয়ে যখন এধারে আসছে তখন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা বর্ডার গার্ড ওদেরকে জোর করে ফিরিয়ে দিচ্ছে।

শুক্রবারের পত্র-পত্রিকায় কয়েকটি অত্যন্ত ডিস্টার্বিং খবর বেরিয়েছে। আরাকান রাজ্যের মংডুর আরও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের দিকে ধাবিত হচ্ছে মিয়ানমারের সাঁজোয়া বাহিনী। প্রতিদিনই রোহিঙ্গা মুসলিম নির্মূলে পরিচালিত ক্লিয়ারেন্স অপারেশনে সৈন্য সমাবেশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সাথে বাড়ছে গণধর্ষণ।
সাঁজোয়া বহরে নতুন করে যুক্ত হয়েছে হেলিকপ্টার গানশিপ, মর্টারশেলবাহী কামান ও মেশিনগান। এসব ভারী অস্ত্র নিয়ে অসহায় গ্রামবাসীর ওপর সৈন্যরা হামলে পড়ছে। ইতোমধ্যে বর্মী বাহিনীর ধ্বংস করে দেয়া গ্রামগুলো থেকে বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে লাশপচা গন্ধ। এরই মধ্যে ২২টি গ্রাম পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে রোহিঙ্গা পল্লীতে গুলী করা হয়েছে। মংডুর উত্তরাঞ্চলে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী নাফ নদী সরু থাকায় যেসব রোহিঙ্গা প্রাণে বেঁচে গেছে তারা নতুন আশ্রয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এতে পালিয়ে আসা নারী-পুরুষদের প্রাণ রক্ষা হলেও এবারের অভিযানে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কারো আর পালিয়ে যারায়ার সুযোগ নেই। কেননা সেনাবাহিনী দক্ষিণে ধাবিত হয়ে রোহিঙ্গাদের কোণঠাসা করে ফেলছে। এখন তাদের পালানোর একমাত্র জায়গা সমুদ্র। আর প্রাণ বাঁচাতে সাগরে ঝাঁপ দিয়েও কোনো লাভ নেই। কেননা সাগর পাড়ি দেয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। নৌকা নিয়ে পালানোর চেষ্টা করলেও সেখানে ওঁৎ পেতে আছে বর্মী নৌবাহিনী। কাজেই জলেস্থলে কোথাও নিস্তার নেই রোহিঙ্গা মুসলিমদের। অনেকটা জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘের মতো অবস্থা। অর্থাৎ অবধারিত মৃত্যু।

ইতোমধ্যে আরাকানের মংডু, বুচিদং, আকিয়াবসহ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার গ্রাম-মহল্লা-পাড়াগুলোর বাড়িঘর প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। পালিয়ে আশ্রয় নেয়া প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা, কেটে কেটে টুকরো অথবা গলা কেটে আর পিটিয়ে হত্যা করছে। আর রোহিঙ্গা নারীদের গণধর্ষণ করছে। 
এ দিকে টেকনাফ উপজেলার চারটি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা বোঝাই ১১টি নৌকা বাংলাদেশে এলে তাদের বাধা দেয় বিজিবির সদস্যরা। গত বৃহস্পতিবার ভোরে বাংলাদেশে ঢুকতে না পেরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ফেরত যায়। যেসব পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা বেশি প্রবেশের চেষ্টা করছে সেসব পয়েন্টে বিজিবির সর্বোচ্চ নজরদারি আছে। পাশাপাশি সীমান্তজুড়ে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের ওপর বর্মী হানাদার বাহিনী যে বীভৎস নির্যাতন চালাচ্ছে তেমন বীভৎস নির্যাতন পাক বাহিনীও ’৭১ সালে বাঙ্গালীদের ওপর চালায়নি। নৌকাযোগে পলায়নরত রোহিঙ্গা মুসলমানদের স্পিডবোট দিয়ে তাড়া করে হত্যা করা, হেলিকপ্টার গানশীপ থেকে গুলী করে হত্যা করা, ঘরে ঘরে গিয়ে রোহিঙ্গা নারীদের টেনে বের করে পাইকারী ও গণহারে ধর্ষণ করার কথা ’৭১ সালের পাক-বাহিনীর নির্যাতনকেও ম্লান করে দিয়েছে। বর্বরতার ধরন মধ্যযুগীয় নির্যাতনকেও হার মানায়। অথচ বাংলাদেশের সেক্যুলাররা মানবতার এই চরম লাঞ্ছনার পরেও সম্পূর্ণ নির্বিকার। তারা সব মুখে কলুপ এঁটেছে। কোথায় গেল আওয়ামী লীগ? কোথায় গেল কমিউনিস্ট পার্টি? কোথায় গেল বাসদ? কোথায় গেল তাদের তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবীরা? বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে ল্যাটিন আমেরিকার কোথাও সামান্যতম মানবাধিকারের লঙ্ঘনের ঘটনায় যারা তারস্বরে নিন্দায় মেতে ওঠে। কিন্তু মানবতার এই নৃশংসতম অপমানেও ওরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়।

কাশ্মীরে এই সেদিনও ২ মাস ধরে কার্ফিউ জারি করে শতাধিক ব্যক্তিকে ভারতীয়  সৈন্যরা হত্যা করলেও ওরা চোখ বন্ধ করে থাকে। ফিলিস্তিনে ইসরাইলী বর্বরতা নিয়ে ওরা সোচ্চার নয়। বাংলাদেশের নাসিরনগরে যখন প্রমাণিত হলো হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা করেছে সরকারি দল, যখন প্রমাণিত হলো যে গাইবান্ধায় সাঁওতাল পল্লীতে হামলা করেছে সরকারি দল, তখন ওরা মুখে গোমটাই লাগিয়েছে। প্রথমে তারা খুব চিৎকার করেছে। তখন ভেবেছিল যে ইসলামী ঘরানার তরফ থেকে এগুলো করা হয়েছে। কিন্তু যেই দেখা গেল এইগুলোর পেছনে রয়েছে তথাকথিত সেক্যুলার ফোর্স, ওমনি তারা গর্তে সেঁদিয়ে যায়। যেখানেই ইসলাম বা মুসলমানদের গন্ধ আছে সেখানেই ওরা ধিক্কার ও নিন্দাবাদে উচ্চকণ্ঠ হয়। আর যেই দেখা যায় ইসলাম বা মুসলমানের কোনো সংস্পর্শ নাই, ওমনি ওরা মিউ মিউ করে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেদেশের সেনাবাহিনী ও পুলিশের নির্যাতনের মুখে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে নাফ নদী হয়ে পালাতে গিয়েও রেহাই পাচ্ছেন না নির্যাতিত মুসলিম রোহিঙ্গারা। দেশ ছেড়ে পালাতে গিয়ে রোহিঙ্গা বোঝাই একটি নৌকা বুধবার রাতে সে দেশের বর্ডার গার্ড পুলিশ-বিজিপির টার্গেটে পড়ে। ৪২ জন রোহিঙ্গা বহনকারী নৌকায় গুলী চালায় বিজিপি। এতে নারী ও শিশুসহ বেশ কয়েকজন গুলীবিদ্ধ হন। তবে কতজন মারা গেছে সে খবর জানা যায়নি। আহত একজনকে মুমূর্ষু অবস্থায় নাফ নদীর পানিতে ভাসতে দেখে বাংলাদেশের জেলেরা উদ্ধার করে টেকনাফের লেদাতে অবস্থিত একটি অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়ে আসে। বুধবার রাতে নৌকাযোগে দুই ছেলেকে নিয়ে পালানোর সময় আহত হয়ে কোনোমতে বেঁচে আসা ওই রোহিঙ্গার নাম ইমান হোসেন। জেলেরা তাকে উদ্ধার করলেও তার দুই ছেলের ভাগ্যে কি ঘটেছে জানেন না ইমান। ৪৮ বছর বয়সী রাখাইন রাজ্যের পেরামপুরো গ্রামের কৃষক ইমান হোসেনের বাবার নাম পিতা মৃত কালু মিয়া। ১২ অক্টোবর তাদের এলাকায় সেনাবাহিনী হামলা শুরু করে। তাদের ঘরটি পুড়িয়ে দেয়। স্ত্রী ও ছোট সন্তান পাশের এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। আর তিনি বড় দুই ছেলের জীবন রক্ষার জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে আসেন। কিন্তু নিয়তির কি পরিহাস, যে ছেলেদের জীবন বাঁচাতে তিনি বাড়ি ছাড়েন, তাদের দু’জনকে মৃত্যুর মুখে রেখে আসতে হয়েছে বাবাকে। ইমান হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বুধবার রাত ৯টার দিকে রাখাইন রাজ্যের মংডুর পেরামপুরো চরে এক থেকে দেড় হাজার রোহিঙ্গা ছিল এপারে আসার অপেক্ষায়। সেখান থেকে ৬টা নৌকা রওনাও হয়। তারা যে নৌকায় ওঠেন সেখানে ছিল ৪২ জন রোহিঙ্গা। তাদের সঙ্গে তার দুই ছেলে সলিমুল্লাহ (১৮) ও সালামত খানও (১৪) ছিল। নৌকার আরও যারাা ছিলেন তাদের মধ্যে ১০ জন নারী, ৮-১০ জন শিশু ও ২০ জন পুরুষ ছিল। সব মিলিয়ে ৪২ ছিলেন। নৌকাটি রওনা হয়ে মাত্র নাফ নদীর কাছে আসে। এ সময় গুলীর শব্দ শুনি। হঠাৎ করে দেখি মিয়ানমারের বিজিপির স্পিডবোট চলে আসে। এসেই গুলী শুরু করে। এ সময় নৌকার মধ্যে পানি ঢুকে যায়। সবাই নৌকার পাটাতনের নিচে আশ্রয় নেয়। কিন্তু বিজিপি খুঁজে খুঁজে বের করে তাদের ওপর গুলী করতে থাকে। এক সময় নৌকাটি স্পিডবোটের সঙ্গে বেঁধে টানতে শুরু করে বিজিপি। ইমান জানান, নৌকার মাঝি লাফ দিয়ে নদীতে পড়ে যায়। তিনিও জীবন রক্ষার জন্য দুই সন্তান ফেলে নদীতে ঝাঁপ দেন। এখন তিনি জানেন না তার দুই ছেলেসহ অন্যদের জীবনে কি ঘটেছে। তিনি বলেন, আমি দেড় ঘণ্টার মতো সাঁতরে নাফ নদীর মাঝখানে চলে আসি। বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার শুনে জেলেরা আমাকে উদ্ধার করে। পরে জেলে আবদুস সালামের বাড়িতে আমাকে আশ্রয় দেয়। একটা লুঙ্গি দেয়। রাতের খাবার দেয়।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং রাখাইন বৌদ্ধদের সম্মিলিত হামলায় যখন সুপরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে, যখন হেলিকপ্টার গানশীপ থেকে গুলী করে অসহায় নিরস্ত্র মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে, যখন রোহিঙ্গা নারীদের ঘর থেকে বের করে পাইকারী হারে ধর্ষণ করা হচ্ছে, যখন তাদের এই মহাবিপদে কেউ পাশে দাঁড়াচ্ছে না, তখন একটি বৃহৎ শক্তি মৌখিকভাবে হলেও রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক শক্তি প্রয়োগ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। এই বৃহৎ শক্তিটি হলো গণচীন। বাংলাদেশ যখন আনুষ্ঠানিকভাবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে অস্বীকার করেছে, যখন বাংলাদেশের কোস্ট গার্ড এবং সীমান্ত রক্ষী বাহিনী রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানদের পুশ ব্যাক করে মিয়ানমারে ঠেলে দিচ্ছে, তখন চীন আনুষ্ঠানিকভাবে ৩ হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে এবং আরো রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণ করবে বলে জানিয়েছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে চীন ঘোষণা করেছে যে, রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান সামরিক শক্তি দিয়ে নয়, বরং আলোচনার মাধ্যমে হওয়া উচিত।

 আজ আমেরিকা এবং পশ্চিমা দুনিয়া স্বীকার করছে যে, বর্তমানে পৃথিবীতে রোহিঙ্গারা সবচেয়ে নিপীড়িত জাতি। পরিস্থিতি যেখানে এতো গুরুতর সেখানে সেই পরিস্থিতি দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিকট মোটেই গুরুত্ব পাচ্ছে না। রাশিয়া তথাকথিত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার গালভরা বুলি নিয়ে সিরিয়ায় বোমা মেরে চলেছে। অথচ মিয়ানমারে নিরস্ত্র জনতাকে একটি সামরিক চক্র বছরের পর বছর ধরে নিধন করে যাচ্ছে, মানবতার এতো বড় অপমানেও এবং মানবাধিকার এমন ভয়াবহ রূপে লঙ্ঘিত হলেও রাশিয়ার কোনো বিকার নাই। ভারত নিজ দেশে এবং বিদেশে মানবাধিকারের বড় ফেরিওয়ালা। বাংলাদেশে সম্প্রদায় বিশেষের সামান্য ক্ষতি হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে তারা সে ব্যাপারে নাক গলায়। এই তো কয়েক বছর আগেও ভারত বাংলাদেশের পার্বত্য সমস্যায় নাক গলিয়েছিলো। অজুহাত ছিলো, তার সীমান্তে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে তার নাকি নিরাপত্তা বিঘিœত হয়। মিয়ানমারও ভারতের প্রতিবেশী। অথচ সেখানে লাখ লাখ মানুষকে ঘরছাড়া করা হচ্ছে। ১৯৭৮ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ২৫ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানের মধ্যে ১২ লাখকেই ঘরছাড়া করেছে। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্ট মোতাবেক গত অক্টোবর মাস থেকে আরাকানে যে জাতিগত নিধন চলছে তার ফলে মাত্র ২ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ১ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান বাস্তুহারা হয়েছে।

এমন পটভূমিকায় সামরিক শক্তির পরিবর্তে আলাপ-আলোচনার যে আহ্বান গণচীন করেছে সেটি শুধু মুখে বললেই চলবে না। সেটিকে কার্যকর করার জন্য মিয়ানমার সরকারের ওপর গণচীনের চাপ প্রয়োগ করতে হবে। সকলে সকলের ওপর চাপ দিতে পারে না। মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করার ব্যাপারে গণচীনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আজ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বর্মী হানাদার বাহিনী যে অস্ত্র ব্যবহার করছে সেটিও সরবরাহ করেছে চীন। বাংলাদেশের মানুষ তাই আশা করে মিয়ানমার সরকারের এই গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধ করার জন্য চীন সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

বুধবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৬

পর্নোগ্রাফি : জীবন ধ্বংসের হাতিয়ার

পর্নোগ্রাফি কথাটির সাথে আমরা এখন বেশ পরিচিত। এর অর্থ হলো- যৌন উদ্দীপনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যৌনসংক্রান্ত বিষয়বস্তুর প্রতিকৃতি অঙ্কন বা পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা। সম্প্রতি নারীদেহ, নারীর রূপ-সৌন্দর্য, পোশাক-আশাক তথা নারীর সামগ্রিক যৌনতাকে উপজীব্য করে অকথ্য, অব্যক্ত, বিকৃত ও কুরুচিপূর্ণ যৌনতায়ভরা কতিপয় ওয়েবসাইটে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা দেখা যায়। এর আধুনিক নাম হচ্ছে ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফি। কিন্তু এই শব্দটিই যে আমাদের সন্তানদেরসহ গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে কলুষিত বা ধ্বংস করে দিচ্ছে সে বিষয়টি হয়তো কখনো চিন্তা করিনি। আমাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের রয়েছে নিজস্ব মোবাইল ফোন। আবার অনেকেরই রয়েছে একাধিক ফোন। অধিকাংশ ফোনেই রয়েছে মেমরি কার্ড ব্যবহার সুবিধা। ভাল ও মন্দ দুধরনের কাজেই মেমরিকার্ড ব্যবহার হয়। এর মাধ্যমেই খুব সহজে অন্যায় ও গর্হিত কাজে জড়িয়ে পড়া যে কারো পক্ষে খুবই সহজ। বিতর্কিত কাজ থেকে নিজেরা বিরত থাকলেও আমাদের সন্তানদের বিরত রাখছি কিনা সেটিও গুরুত্বের সাথে দেখা উচিত।
কেননা, গত ১ অক্টোবর জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশননামের একটি সংস্থা বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি: সংবাদ বিশ্লেষণ ও বিশেষজ্ঞ অভিমতশীর্ষক এক অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকায় স্কুলগামী শিশুদের প্রায় ৭৭ শতাংশ পর্নোগ্রাফি দেখে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেশে তৈরি এই পর্নোগ্রাফিগুলোয় যাদের ভিডিও দেখানো হচ্ছে, তাদের বয়স ১৮ বছরের কম। অনুষ্ঠানে সংস্থার শিশু সুরা কার্যক্রমের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ৫০০ স্কুলগামী শিক্ষার্থীর ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, সুস্থ যৌন শিক্ষার বিপরীতে বিকৃত যৌন শিক্ষার মধ্যে বেড়ে উঠছে। সংস্থার গবেষণায় আরো দেখা গেছে, চারটি পদ্ধতিতে অশ্লীল ভিডিও তৈরি হচ্ছে।
এর মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি পর্নোগ্রাফির চেয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে ঘিরে পর্নোভিডিও মানুষ বেশি দেখছে। যুক্তরাজ্যে ছেলেদের অনলাইনে প্রথম পর্নো ছবি দেখার গড় বয়স মাত্র ১১! আর ১৩-১৮ বছর বয়সী ৩ হাজার বালকের ওপর পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, তাদের ৮১ শতাংশই অনলাইনে পর্নো দেখছে।২০১৩ সালে ঢাকার কয়েকটি স্কুলে পরিচালিত একটি বেসরকারি টেলিভিশনের পরিচালিত অপর এক জরিপে দেখা যায়, ‘স্কুল শিক্ষার্থীদের ৮২ শতাংশ ছেলেমেয়ে স্বীকার করে যে, তারা সুযোগ পেলে মোবাইলে পর্নো ছবি দেখে। প্রায় ৬২ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসে বসেই পর্নো ছবি দেখে। প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা মোবাইলের পেছনে ব্যয় করে। আর ৪৪ শতাংশ শিক্ষার্থী জানায় তারা কেবল প্রেম করার উদ্দেশ্যে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে।
বর্তমান প্রজন্মের জন্য বড় একটি ঝুঁকি হলো, অনলাইনে পর্নোগ্রাফি দেখা। বাস্তবে পাওয়া যায় না এমন আকর্ষণ ও চাহিদা মেটাতেই পর্নোগ্রাফি দেখছে বলেই গবেষণা থেকে জানা যায়। যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ১৯৫৫ সালে পর্নোগ্রাফি ও অশ্লীলতাকে সভ্যতার কালো দাগ বলে মন্তব্য করেছেন। জার্মানের একদল গবেষক বলেছেন, ‘নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখলে মস্তিষ্কের একটি বিরাট অংশ সংকুচিত হয়ে কার্যক্ষমতা কমে যায়। প্রাপ্তবয়স্করা দোষীবিনোদন হিসেবে পর্নোগ্রাফি দেখে। অনেক অভিভাবকরা শিশুদেরকে দামি ফোন, ট্যাব ও সেগুলোয় ইন্টারনেট সংযোগ দিচ্ছেন। কিন্তু তারা কী কাজে এগুলো ব্যবহার করছে, সে বিষয়ে খোঁজ খবর রাখা মৌলিক দায়িত্ব। পর্নোগ্রাফি দেখলে মুহূর্তে সে যৌনতার কল্পরাজ্যে ঘুরে বেড়ায়। মানবদেহে সুখানুভূতির অনুভূতি জাগায়। বিভিন্ন কৌশল ও নেতিবাচক চিন্তায় সে জর্জিত হয়ে বাস্তবে পরিণত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
অবৈধ পন্থায় এমন কর্মে লিপ্ত হতে গিয়ে লজ্জা হারিয়ে ফেলে। এর ফলে স্বাস্থ্যগত ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। এতে করে, শিশুদের যৌন জীবন ও ভবিষ্যৎ দাম্পত্য সম্পর্ক ধ্বংস হচ্ছে। পর্নো আসক্তি হলে-নৈতিক অবক্ষয়, যৌন নিপীড়ন, পারিবারিক কলহ, হতাশা, সামাজিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। রুচি বোধের অবনতি হয়, নিঃসঙ্গতা চেপে বসে, শারীরিক ক্ষতি হয়, সামাজিকভাবে হেয় হতে হয়, বৈবাহিক জীবনে নারী-পুরুষ একে অপরকে ঘৃণার চোখে দেখে এবং পরকালে শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।
পর্নোগ্রাফি থেকে সন্তানদের দূরে রাখতে চেষ্টা করতে হবে। ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফির প্রায় শতকরা ২০ ভাগ অপ্রাপ্তবয়স্কদের নিয়ে। প্রতি সপ্তাহে ২০,০০০-এর বেশি অপ্রাপ্তদের ছবি ইন্টারনেটে পোস্ট করা হয়।। সীমা লংঙ্ঘন ও মন্দ বিষয় থেকে আমাদের সন্তান ও তরুণ প্রজন্মকে সুরক্ষার জন্য পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট কতিপয় দায়িত্ব রয়েছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্বই মৌলিক ভূমিকা হিসেবে কাজ করবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পর্নোগ্রাফির সাথে সম্পর্কিত ২০০ শব্দের ওপর সংবরণ দেয়া আছে। কেউ ওই শব্দগুলো লিখে সার্চ দিলে সার্ভারে নোটিফিকেশন যায়। অনুমোদন ছাড়া ওই সব সাইটে ঢোকা যায় না।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের দিকে তাকালে দেখতে পাই, চীনে পর্নোগ্রাফি ব্যবস্থাপনা রয়েছে, সিঙ্গাপুরে নিজস্ব নীতিমালা রয়েছে, মালয়েশিয়ায় সমাজোপযোগী ফিল্টারিং ব্যবস্থা, সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরব মুসলিম সমাজে নেতিবাচক সাইট ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং ইন্টারনেটভিত্তিক সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটসমূহ প্রবেশের অগ্রহণযোগ্য। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও নেতিবাচক সাইটগুলোকে সরকার কেন ফিল্টারিং করছে না সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সরকারের বিরুদ্ধে কেউ কোন ধরনের কটূক্তি করলে বা বিতর্কিত কোনো ছবি পোস্ট করলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬, তথ্য ও প্রযুক্তি (সংশোধিত) আইন ২০১৩ প্রয়োগ করে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হলে অশ্লীল ছবি, ভিডিও পোস্টকারী ও পর্নোসাইট নিয়ন্ত্রণে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২-এ দণ্ডবিধির যে ধারা উল্লেখ রয়েছে তা কেনো বাস্তবায়ন করা হবে না? যথা শীঘ্রই ইন্টারনেট ব্যবহারে শৃঙ্খলা আনতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে যৌন সংবেদনশীলতা, পর্নো বই, সিডি, ভিডিও তৈরি ও প্রচার কিংবা ডাউনলোড করে যারা সরবরাহ করছেন তাদেরকে অনুসন্ধান করে বের করা উচিত।
মনে রাখতে হবে, নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি প্রবল আগ্রহ, পর্নোগ্রাফির অতিমাত্রায় সহজলভ্যতা, সন্তানদের কর্মকাণ্ডের ওপর অভিভাবকদের যথাযথ নজরদারি, প্রযুক্তির অসৎ ব্যবহার, ধর্মীয় অনুশাসন, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে আইনের বাস্তবায়ন ও ইন্টারনেট ফিল্টারিং না থাকা আসক্তির অন্যতম কারণ।
মাতা পিতার উচিত শিশুদের সঙ্গে বয়ঃসন্ধিকালের শুরুতেই অর্থাৎ ১০ বছর বয়সেই স্বাস্থ্যকর ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা শুরু করা। পর্নোগ্রাফি ব্যবহার আইন করে বন্ধের চেয়ে এর খারাপ দিকগুলো বুঝাতে সক্ষম হলে অবশ্যই ইতিবাচক কাজে সন্তানরা আগ্রহী হবে। ইন্টারনেট ব্রাউজার হিস্টোরী চেক করা। বিভিন্ন ওয়েবসাইট ব্রাউজিং করতে করতে অনাক্সিক্ষতভাবে কোনো পর্নো ওয়েবসাইট সামনে চলে আসতে পারে, তাই ওয়েবসাইট ব্লক করার পদ্ধতি জানতে হবে। কম্পিউটারের মনিটর এমনভাবে সেট করা যাতে বাসার সবাই তা দেখতে পায়।
সন্তানদের সাথে বন্ধুর মতো মিশে বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ ও কোনো সমস্যার সমাধান দেয়ার চেষ্টা করা। শিশুদের খেলাধুলাসহ বিনোদানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। মা-বাবা যতই ব্যস্ত থাকুক না কেন সন্তানকে মানুষ করতে চাইলে তাদেরকে সময় দিতে হবে। কোনটি ভালো আর কোনটি মন্দ সে বিষয়ে পৃথক করার জ্ঞান শিক্ষা দিতে হবে। সন্তানের মোবাইল ফোন, সিডি, মেমরি, পেনড্রাইভ, ট্যাব, ল্যাপটপ, কম্পিউটার ইত্যাদি লুকিয়ে রাখছে কিনা বা পাসওয়ার্ড দিয়ে লক করা, অশ্লীলতার কাজে ব্যবহার সম্পর্কে খোঁজ রাখা।
রাতে কিংবা দিনের কোনো সময়ে একাকী ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করুন। কোনো আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও সংরক্ষণ করছে কিনা তা খতিয়ে দেখা। এছাড়া পর্নোগ্রাফি সম্পর্কে ইসলামের দিক নির্দেশনাগুলো মানতে হবে। আল কুরআনে বলা হয়েছে -তাদের বলে দাও (হে মুহাম্মদ): আমার প্রতিপালক প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অশ্লীলতা, পাপকাজ নিষিদ্ধ করেছেন। (৭:৩৩)। মুসলিম শরীফের এক হাদিসে বলা হয়েছে, ‘কোনো পুরুষ বা নারীর উচিত নয় অপর কোন পুরুষ বা নারীর গোপনাঙ্গের দিকে দৃষ্টিপাত করা। এককথায়, নৈতিক মূল্যবোধের বিকল্প নেই।


শনিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৬

তুলির আঁচরে............



তুলি, গোবিন্দপুর গাঁয়ের এক দরিদ্র কৃষক মছির উদ্দিনের মেয়ে। ভাগ্যের  লিখনেই হোক কিংবা গৌড় গোবিন্দের অনুরোধেই হোক চোখ শীতল করা গাঁয়ের শ্যামলতার চাদরে মুড়িয়ে-ই বুঝি বিধাতা তাকে শ্যামলা রুপে সৃষ্টি করেছেএতে বাবা মছিরের কোনো আপত্তি নেই, কেননা দীর্ঘ পাঁচ-ছ’বছর ধরে সে একটি কন্যার জন্য বিধাতার কাছে কতো আকুতি-ই না করে আসছিল
লোকো-মুখে এ কথা আমরা সবাই শুনে থাকি যে, গাঁয়ের মানুষগুলো বড্ড সহজ সরল হয়েই জন্মায়, এ যেনো বিধাতার দেয়া এক অপার করুণা। তা-ই যদি হয়, তবে সে গাঁয়েরই মেয়ে তুলি সহজ-সরলা, মিশুক-চঞ্চলা প্রকৃতির হবে তা তো সকলেরই জানার কথা বৈকি।
ঠিক তা-ই, তুলিও ততটুকু শান্ত, যতটুকু না রইলেই নয়। পড়ার সময় পড়া আর খেলার সময় খেলা কথাটি কানে নিলেও কারো বিপদের সময় তা মানতে নারাজ সবে এগারো-য় পা দেয়া এই কিশোরীর, এতে যতই থাকুক না জমা সমুদ্রাধিক পড়া কিংবা না হোক দিনের পর দিন খেলার সাথীদের সাথে মিলন।
তাই তো মাঝে মাঝে তার স্বপ্নের গল্প শুনে অভিভূত হয়ে থাকে পাড়ার সকলে।

মঙ্গলবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৬

যুদ্ধ কোনো সমাধানের নাম হতে পারে না.........

"যখন আমি হতাশ হই, তখন আমি স্মরণ করি সমগ্র ইতিহাসেই সত্য ও ভালবাসার জয় হয়েছে। দুঃশাসক ও হত্যাকারীদের কখেনা অপরাজেয় মনে হলেও শেষে সবসময়ই তাদের পতন ঘটে মনে রাখবেন সর্বদাই ।"
উক্তিটি যে দেশের অধিবাসীদের বিশেষভাবে মনে থাকার কথা, আজ তারা-ই এর বিরুদ্ধাচারণ করতে একটুও সংকোচবোধ করছে না ।
স্পষ্ট করে বলতে গেলে, আমার বুলির নিশানা আমাদের বন্ধুত্ব পূর্ণ প্রতিবেশী দেশ ভারতকেই ছেদ করছে। কারণ, উপরোক্ত উক্তিটি স্বাধীন ভারতের মহানায়ক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (মহাত্মা গান্ধী)-র।

আজ ভারত ও তারই প্রতিবেশী দেশ পাকিস্থান যে বিষয়গুলোকে সামনে এনে পরস্পরের সাথে যৌক্তিক আলোচনার বিপরীতে ঝগড়াকে যুদ্ধের রুপ দিতে যাচ্ছে, তা কাশ্মীরের অসহায় জনগণের দুর্ভোগের চেয়ে কখনোই বড় হতে পারে না। কিন্তু আজ থেকে প্রায় ৯৩ বছর আগে এর চেয়ে বহুগুণ বড় বিবাদ ঠেকানোর জন্য অন্যকে নয় বরং নিজেকে কষ্ট দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তিনি অনশনের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ঠেকিয়ে বিশ্বকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছেন যুদ্ধ নয় একমাত্র ভালবাসা-ই পারে নদীর দুই প্রান্তের মানুষকে একত্রিত করতে।
আমার কেনো জানি মনে হয়, আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন, তবে কাশ্মীর-সমস্যার কোনো কোনো একটা সুরাহ তিনি অবশ্যই করতেন।
শুধু তিনি একা নন। এই দুর্গমগিরি পথের পথিকদের অনেকের মধ্যে নেলসন ম্যান্ডেলা ও একজন । যিনি শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ সমস্যা নিরসনের জন্য নিজের জীবনের একটা বড় সময়কে কারাগারের মধ্যে হাসি মুখে কুরবানী দিয়েছেন। তাঁর মাধ্যমেই বিশ্ববাসী প্রথম বুঝেছিল কালো ও ধলো দুটি রঙ মাত্র, এটি কখনোই একটি জাতি বিভেদের ইস্যু হতে পারে না।
আমার মাথায় আসে না, ভারত ও পাকিস্থান এই সামান্য বিষয়টি কেনো বুঝতে পারছে না যে, মাইনাসকে যতবারই প্লাস(+) দ্বারা গুণ(x) করা হোক না কেনো তা থেকে কখনোই প্লাস(+) অর্থাৎ সফলতা আশা করা যায় না বরং গুণশেষ হিসেবে সর্বদাই মাইনাস(-) অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ ক্ষতির শিকার হতেই হবে এটা আপনি মানুন কিংবা না-ই বা মানুন।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা যেমন একদিকে চেঁচিয়ে বলছে এই দাঙ্গার ফলে দুই দেশের বিপুল পরিমাণ নিরহ জনগণ বলির ছাগল হবে তেমনি অন্য আরেকপ্রান্তে পরিবেশবিদরা বিলাপ করছে যে, এতে শুধু দুই দেশেরই ক্ষতি হবে না বরং এর প্রভাব পড়বে সারা পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর উপরে।
এজন্য চাটুকারদের কথায় কান না দিয়ে উভয় দেশেরই উচিত হবে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যকার যাবতীয় বিভেদের অবসান ঘটানো।
মনে রাখতে হবে যে, হিন্দু ও মুসলমান পৃথিবীর বুকে আলাদা কোনো জাতি নয় বরং দুটি ধর্ম মাত্র।

শুক্রবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৬

ক্ষমা করো ওমরান 

মিডিয়ার খবরে ভেসে উঠে
পাঁচ বছরের ওমরানের রক্তস্নাত শরীর 
মাথায় তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে হাতে নিল সে 
একি! এযে রক্ত! --- চমকায় কি সে?
হে বেহায়া বিশ্ব মানব সভ্যতা !
হে অন্ধ বিশ্ব বিবেক রক্তের গন্ধ বিচলিত করে না ধ্বংসের এই রূপ ?
কি বীভৎস ! কি ভয়ংকর !
আশ্চর্য হয়ে ভাবি, কেন পারছিনা বলতে কিচ্ছুটি কাউকে
ক্ষোভ থৈ থৈ সমগ্র সত্তা নিমজ্জিত হয় গহীন সমুদ্দুর-
বারুদের গন্ধ - তাজা প্রাণের আর্তনাদ ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়ে রক্ত কণা
সর্বগ্রাসী যন্ত্রণা, অবসাদ, বিস্মরণ, কুচক্রী চাল গিলে খায় সময়।
প্রেমহীন শূন্য মহাকাশের তলে, বেদানার্ত পৃথিবী’পরে
আমি নির্বাক অশ্রুহীন চোখে স্থির অচঞ্চল
চোখের আগুনে দূর করতে চাই নিমজ্জত অন্ধকার সময় !!

শনিবার, ১৪ মে, ২০১৬

বোধ
......জীবনানন্দ দাশ
আলো-অন্ধকারে যাই__মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, __কোন এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয়__শান্তি নয়__ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাজ তুচ্ছ হয়,__পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা__প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়!
সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে!
কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো! তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর!__কোনো নিশ্চয়তা
কে জানিতে পারে আর?__শরীরের স্বাদ
কে বুঝিতে চায় আর?__প্রাণের আহ্লাদ
সকল লোকের মতো কে পাবে আবার!
সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর
স্বাদ কই!__ ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,
শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
চাষার মতন প্রাণ পেয়ে
কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর ’পরে?
স্বপ্ন নয়,__ শান্তি নয়,__কোন এক বোধ কাজ করে
মাথার ভিতরে!
পথে চলে পারে__পারাপারে
উপেক্ষা করিতে চাই তারে;
মড়ার খুলির মতো ধরে
আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে
তবু সে মাথার চারিপাশে!
তবু সে চোখের চারিপাশে!
তবু সে বুকের চারিপাশে!
আমি চলি, সাথে সাথে সেও চলে আসে!
আমি থামি,__
সেও থেমে যায়;
সকল লোকের মাঝে বসে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথের শুধু বাধা?
জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে
সন্তানের জন্ম দিতে দিতে
যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়
কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়
যাহাদের; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজক্ষেতে আসিতেছে চলে
জন্ম দেবে__জন্ম দেবে বলে;
তাদের হৃদয় আর মাথার মতন
আমার হৃদয় না কি?__তাহাদের মন
আমার মনের মতো না কি?
__তবু কেন এমন একাকী
তবু আমি এমন একাকী!
হাতে তুলে দেখিনি কি চাষার লাঙল?
বালটিতে টানিনি কি জল?
কাস্তে হাতে কতবার যাইনি কি মাঠে?
মেছোদের মতো আমি কত নদী ঘাটে
ঘুরিয়াছি;
পুকুরের পানা শ্যালা__ আঁষটে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে
গিয়েছে জড়ায়ে;
__এই সব স্বাদ;
__এ সব পেয়েছি আমি,__বাতাসের মতন অবাধ
বয়েছে জীবন,
নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন
একদিন;
এই সব সাধ
জানিয়াছি একদিন,__অবাধ__অগাধ;
চলে গেছি ইহাদের ছেড়ে;__
ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
অবহেলা করে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;
আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,
আসিয়াছে কাছে,
উপেক্ষা সে করেছে আমারে,
ঘৃণা করে চলে গেছে__যখন ডেকেছি বারেবারে
ভালোবেসে তারে;
তবুও সাধনা ছিল একদিন,__এই ভালোবাসা;
আমি তার উপেক্ষার ভাষা
আমি তার ঘৃণার আক্রোশ
অবহেলা করে গেছি; যে নক্ষত্র__নক্ষত্রের দোষ
আমার প্রেমের পথে বারবার দিয়ে গেছে বাধা
আমি তা ভুলিয়া গেছি;
তবু এই ভালবাসা__ধুলো আর কাদা__।
মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়__প্রেম নয়__কোনো এক বোধ কাজ করে।
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে :
সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?
কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ
পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ
মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!
মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!
এই বোধ__শুধু এই স্বাদ
পায় সে কি অগাধ__অগাধ!
পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ
চায় না সে?__করেছে শপথ
দেখিবে সে মানুষের মুখ?
দেখিবে সে মানুষীর মুখ?
দেখিবে সে শিশুর মুখ?
চোখে কালোশিরার অসুখ,
কানে যেই বধিরতা আছে,
যেই কুঁজ__গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে
নষ্ট শসা__পচা চালকুমড়ার ছাঁচে,
যে সব হৃদয়ে ফলিয়াছে
__সেই সব।