ইসলামের উদ্দেশ্য ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি। ইসলামি জীবনাদর্শ
বিশ্বের সব মানুষের জন্য। ইসলামের লক্ষ্য হলো মানুষের সমাজে শান্তি,
নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ ও মৌলিক
অধিকার সংরক্ষণ করা। ইসলামি বিধিবিধানের মূল লক্ষ্য মানুষের সার্বিক কল্যাণ
নিশ্চিত করা এবং যাবতীয় অকল্যাণ ও ক্ষতিকর দিক থেকে মানবসমাজকে রক্ষা করা।
মানুষের জানমাল ও ইজ্জত-আব্রুর হেফাজত করার নাম ইসলাম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতএব, তারা ইবাদত করুক এই গৃহের মালিকের, যিনি তাহাদিগকে ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং ভীতি হইতে তাহাদিগকে নিরাপদ করেছেন।’ (সূরা-১০৬ কুরাইশ, আয়াত: ৩-৪)। অর্থাৎ তাদের উচিত বায়তুল্লাহ তথা কাবা শরিফের রবের ইবাদত-বন্দেগি করা, যিনি ক্ষুধা ও ভয়ভীতি থেকে নিরাপত্তা বিধান করেছেন। এতে বোঝা যায়, ইসলামি আদর্শই মানুষের মৌলিক চাহিদা ও মৌলিক অধিকারের একমাত্র রক্ষাকবচ। মানুষ দুনিয়ার জীবনে বেঁচে থাকার তাগিদে চায় সব ধরনের ভয়ভীতি থেকে তার জানমাল, ইজ্জত-আব্রু হেফাজতের নিশ্চয়তা। ইসলামি জীবনব্যবস্থার প্রতিটি দিক ও বিভাগেই রয়েছে মানুষের সব অধিকারের বাস্তব প্রতিফলন। নবী-রাসুলের আগমন এবং আসমানি কিতাবের মূল লক্ষ্য মানুষের সমাজে প্রকৃত শান্তি, কল্যাণ ও ইনসাফ নিশ্চিত করা। সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন এবং সর্বশেষ কিতাব আল-কোরআন নাজিলের চূড়ান্ত লক্ষ্য এটাই। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এর মূল লক্ষ্য।
ইমান আনার ব্যাপারে বলপ্রয়োগ প্রযোজ্য নয়। ইমান বা বিশ্বাস ইসলামি আদর্শ ও জীবনব্যবস্থার ভিত্তি। এই ইমান আনার ক্ষেত্রে ইসলামে বলপ্রয়োগের বা জবরদস্তির কোনো সুযোগ নেই। মানুষের কাছে সত্য ও মিথ্যার, ন্যায় ও অন্যায়ের, হেদায়েত ও গোমরাহির বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে তুলে ধরা ছিল নবী-রাসুলগণের দায়িত্ব। ইমান আনা না-আনার বিষয়টি মানুষের বিবেক, বুদ্ধি ও ইচ্ছার ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন: ‘দীন সম্পর্কে জোর-জবরদস্তি নেই; সত্য পথ ভ্রান্ত হতে সুস্পষ্ট হয়েছে। যে তাগুতকে অস্বীকার করবে, আল্লাহে ইমান আনবে, সে এমন এক মজবুত হাতল ধরবে, যা কখনো ভাঙবে না। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৫৬)। আল্লাহ তাআলা অন্যত্র ঘোষণা করেছেন: ‘বলো, সত্য তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে; সুতরাং যার ইচ্ছা বিশ্বাস করুক ও যার ইচ্ছা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করুক।’ (সূরা-১৮ কাহাফ, আয়াত: ২৯)।
বিশ্বময় চিরস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম মানবভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সে সমগ্র মানবজাতিকে একই পরিবারভুক্ত মনে করে। ইসলামের কথা হচ্ছে, সব মানুষই এক আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি এবং তিনি সমগ্র বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও প্রতিপালক। তিনি প্রত্যেক মানুষকেই মানবীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টির সেরা করেছেন। ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, সব মানুষের উৎপত্তি এক আদম ও হাওয়া থেকে। ইসলাম আরও শিক্ষা দেয়, হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে পরবর্তী সব নবী-রাসুল যেমন: হজরত নূহ (আ.), হজরত ইব্রাহিম (আ.), হজরত মুসা (আ.), হজরত ঈসা (আ.), হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রত্যেকেই ছিলেন ভাই ভাই এবং তাঁদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মহান আল্লাহ বলেন: ‘তোমরা বলো, আমরা আল্লাহতে ইমান রাখি এবং যা আমাদের প্রতি, ইব্রাহিম (আ.), ইসমাইল (আ.), ইসহাক (আ.), ইয়াকুব (আ.) ও তাঁর বংশধরগণের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা তাঁদের প্রতিপালকের নিকট থেকে মূসা (আ.), ইসা (আ.) ও অন্যান্য নবীকে দেওয়া হয়েছে। আমরা তাঁদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না এবং আমরা তাঁরই নিকট আত্মসমর্পণকারী।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৩৬)। মহান আল্লাহ আরও বলেন: ‘মানুষ ছিল একই উম্মত, পরে তারা মতভেদ সৃষ্টি করে। তোমার প্রতিপালকের পূর্বঘোষণা না থাকলে তারা যে বিষয়ে মতভেদ ঘটায়, তার মীমাংসা তো হয়েই যেত।’ (সূরা-১০ ইউনুস, আয়াত: ১৯)।
ইসলাম সব জাতির সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। ইসলাম সবার সঙ্গে ন্যায়পরতা, সুবিচার ও সুন্দর আচরণ করার শিক্ষা দেয়। ইসলামি শরিয়াহ বিশ্বব্যাপী মানবভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে যুদ্ধ সংঘটনের কারণ দূর করতে চায়। ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, শিল্প, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানবভ্রাতৃত্বের নীতিতে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার মধ্যে সহযোগিতামূলক সুসম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হলে যুদ্ধের আশঙ্কা কমে যায়। মানবভ্রাতৃত্বের পাশাপাশি ইসলাম বিশ্বাসের ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চায়। হিজরতের সময় পথ দেখানোর জন্য তিনি মক্কার মুশরিক আবদুল্লাহ ইবনে আরিকতের সাহায্য নিয়েছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) যুদ্ধেও ইহুদিদের সাহায্য নিয়েছেন এবং হুনাইন যুদ্ধে ছওয়ান ইবনে উমাইয়া মুশরিক হওয়া সত্ত্বেও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গী হয়ে যুদ্ধ করেছেন। আল-কোরআনে এক মুসলমানকে অন্য মুসলমানের বন্ধুরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে: ‘মুমিন নর ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু, এরা সৎকার্যের নির্দেশ দেয় এবং অসৎকার্যের নিষেধ করে, সালাত কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে; এদের আল্লাহ কৃপা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা-৯ তাওবাহ, আয়াত: ৭১)। নবী করিম (সা.) মুসলিম উম্মাহকে একটি মানবদেহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই উম্মাহকে একটি প্রাসাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যার এক অংশ অন্য অংশকে শক্তিশালী করে তোলে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘প্রত্যেক মুসলমান একে অন্যের ভাই, কেউ কারও ক্ষতি করে না বা অন্যের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।’ (বোখারী)।
ইসলাম শত্রুর সঙ্গেও ইনসাফপূর্ণ আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। এ ব্যাপারে আল-কোরআনে বলা হয়েছে: ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে; কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদিগকে যেন কখনো সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। সুবিচার করবে, ইহা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করবে। তোমরা যা করো, নিশ্চয় আল্লাহ তার সম্যক খবর রাখেন।’ (সূরা-৫ মায়িদাহ, আয়াত: ৮)। রাসুলুল্লাহ (সা.) পরম শত্রুর সঙ্গেও ভালো আচরণ করেছেন। এ ছাড়া তিনি অমুসলিমদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলতেন। তিনি তাদের সঙ্গে লেনদেন করেছেন এবং শ্রমের বিনিময়ও করেছেন।
পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করা ইসলাম-সমর্থিত নয়। মহান আল্লাহ বলেন: ‘যখন সে প্রস্থান করে তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টির এবং শস্যক্ষেত্র ও জীবজন্তু নিপাতের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ অশান্তি পছন্দ করেন না।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ২০৫)। মহান আল্লাহ আরও বলেন: ‘দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর তোমরা তাতে বিপর্যয় ঘটিয়ো না, তাঁকে ভয় ও আশার সহিত ডাকবে। নিশ্চয় আল্লাহর অনুগ্রহ সৎকর্মপরায়ণদের নিকটবর্তী।’ (সূরা-৭ আরাফ, আয়াত: ৫৬)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে কাসির (র.) বলেন, যেসব কর্মকাণ্ড পৃথিবীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তা করতে আল্লাহ তাআলা নিষেধ করেছেন। কেননা, যখন কাজকর্ম শান্ত পরিবেশে চলতে থাকে, তখন যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, তবে তা হবে বান্দাহদের জন্য বেশি ক্ষতিকর। কোরআন শরিফে রয়েছে: ‘পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করো না।’ (সূরা-২ আল-বাকারা, আয়াত: ১১)।
যুদ্ধ নয়, শান্তিই ইসলামের পরম আরাধ্য। ইসলাম কথায় কথায় যুদ্ধের অনুমতি দেয় না। যেসব ক্ষেত্রে যুদ্ধের অনুমতি রয়েছে, তার উদ্দেশ্যও শান্তি প্রতিষ্ঠা। সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতিসংক্রান্ত আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে: ‘সুতরাং তারা যদি তোমাদের নিকট হতে সরে দাঁড়ায়, তোমাদের সহিত যুদ্ধ না করে এবং তোমাদের নিকট শান্তির প্রস্তাব করে, তবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা অবলম্বনের পথ রাখেন না।’ (সূরা-৪ নিসা, আয়াত: ৯০)।
ইসলাম যুদ্ধাবস্থায়ও শিষ্টাচার ও মানবিকতা অক্ষুণ্ন রাখে। ইসলামে যেসব ক্ষেত্রে যুদ্ধের অনুমতি রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের নির্দেশ দেয়। ইসলাম অতর্কিতভাবে কখনো কারও ওপর আক্রমণ চালানোর অনুমতি দেয় না। ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.) সিরিয়ায় সৈন্যবাহিনী পাঠানোর সময় তাদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন: নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের হত্যা করবে না, লাশ বিকৃত করবে না, সাধু-সন্ন্যাসী ও তপস্বীদের কষ্ট দেবে না; কোনো উপাসনালয় ভাঙচুর করবে না। পশুসম্পদ, ফলবান বৃক্ষ ও ফসলের ক্ষতি করবে না; প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে না। যারা আনুগত্য স্বীকার বা আত্মসমর্পণ করবে, তাদের জানমালকে মুসলমানদের জানমালের মতো নিরাপত্তা দেবে।
মানুষের জানমাল ও ইজ্জত-আব্রুর হেফাজত করার নাম ইসলাম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতএব, তারা ইবাদত করুক এই গৃহের মালিকের, যিনি তাহাদিগকে ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং ভীতি হইতে তাহাদিগকে নিরাপদ করেছেন।’ (সূরা-১০৬ কুরাইশ, আয়াত: ৩-৪)। অর্থাৎ তাদের উচিত বায়তুল্লাহ তথা কাবা শরিফের রবের ইবাদত-বন্দেগি করা, যিনি ক্ষুধা ও ভয়ভীতি থেকে নিরাপত্তা বিধান করেছেন। এতে বোঝা যায়, ইসলামি আদর্শই মানুষের মৌলিক চাহিদা ও মৌলিক অধিকারের একমাত্র রক্ষাকবচ। মানুষ দুনিয়ার জীবনে বেঁচে থাকার তাগিদে চায় সব ধরনের ভয়ভীতি থেকে তার জানমাল, ইজ্জত-আব্রু হেফাজতের নিশ্চয়তা। ইসলামি জীবনব্যবস্থার প্রতিটি দিক ও বিভাগেই রয়েছে মানুষের সব অধিকারের বাস্তব প্রতিফলন। নবী-রাসুলের আগমন এবং আসমানি কিতাবের মূল লক্ষ্য মানুষের সমাজে প্রকৃত শান্তি, কল্যাণ ও ইনসাফ নিশ্চিত করা। সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন এবং সর্বশেষ কিতাব আল-কোরআন নাজিলের চূড়ান্ত লক্ষ্য এটাই। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এর মূল লক্ষ্য।
ইমান আনার ব্যাপারে বলপ্রয়োগ প্রযোজ্য নয়। ইমান বা বিশ্বাস ইসলামি আদর্শ ও জীবনব্যবস্থার ভিত্তি। এই ইমান আনার ক্ষেত্রে ইসলামে বলপ্রয়োগের বা জবরদস্তির কোনো সুযোগ নেই। মানুষের কাছে সত্য ও মিথ্যার, ন্যায় ও অন্যায়ের, হেদায়েত ও গোমরাহির বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে তুলে ধরা ছিল নবী-রাসুলগণের দায়িত্ব। ইমান আনা না-আনার বিষয়টি মানুষের বিবেক, বুদ্ধি ও ইচ্ছার ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন: ‘দীন সম্পর্কে জোর-জবরদস্তি নেই; সত্য পথ ভ্রান্ত হতে সুস্পষ্ট হয়েছে। যে তাগুতকে অস্বীকার করবে, আল্লাহে ইমান আনবে, সে এমন এক মজবুত হাতল ধরবে, যা কখনো ভাঙবে না। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৫৬)। আল্লাহ তাআলা অন্যত্র ঘোষণা করেছেন: ‘বলো, সত্য তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে; সুতরাং যার ইচ্ছা বিশ্বাস করুক ও যার ইচ্ছা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করুক।’ (সূরা-১৮ কাহাফ, আয়াত: ২৯)।
বিশ্বময় চিরস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম মানবভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সে সমগ্র মানবজাতিকে একই পরিবারভুক্ত মনে করে। ইসলামের কথা হচ্ছে, সব মানুষই এক আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি এবং তিনি সমগ্র বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও প্রতিপালক। তিনি প্রত্যেক মানুষকেই মানবীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টির সেরা করেছেন। ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, সব মানুষের উৎপত্তি এক আদম ও হাওয়া থেকে। ইসলাম আরও শিক্ষা দেয়, হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে পরবর্তী সব নবী-রাসুল যেমন: হজরত নূহ (আ.), হজরত ইব্রাহিম (আ.), হজরত মুসা (আ.), হজরত ঈসা (আ.), হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রত্যেকেই ছিলেন ভাই ভাই এবং তাঁদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মহান আল্লাহ বলেন: ‘তোমরা বলো, আমরা আল্লাহতে ইমান রাখি এবং যা আমাদের প্রতি, ইব্রাহিম (আ.), ইসমাইল (আ.), ইসহাক (আ.), ইয়াকুব (আ.) ও তাঁর বংশধরগণের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা তাঁদের প্রতিপালকের নিকট থেকে মূসা (আ.), ইসা (আ.) ও অন্যান্য নবীকে দেওয়া হয়েছে। আমরা তাঁদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না এবং আমরা তাঁরই নিকট আত্মসমর্পণকারী।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৩৬)। মহান আল্লাহ আরও বলেন: ‘মানুষ ছিল একই উম্মত, পরে তারা মতভেদ সৃষ্টি করে। তোমার প্রতিপালকের পূর্বঘোষণা না থাকলে তারা যে বিষয়ে মতভেদ ঘটায়, তার মীমাংসা তো হয়েই যেত।’ (সূরা-১০ ইউনুস, আয়াত: ১৯)।
ইসলাম সব জাতির সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। ইসলাম সবার সঙ্গে ন্যায়পরতা, সুবিচার ও সুন্দর আচরণ করার শিক্ষা দেয়। ইসলামি শরিয়াহ বিশ্বব্যাপী মানবভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে যুদ্ধ সংঘটনের কারণ দূর করতে চায়। ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, শিল্প, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানবভ্রাতৃত্বের নীতিতে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার মধ্যে সহযোগিতামূলক সুসম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হলে যুদ্ধের আশঙ্কা কমে যায়। মানবভ্রাতৃত্বের পাশাপাশি ইসলাম বিশ্বাসের ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চায়। হিজরতের সময় পথ দেখানোর জন্য তিনি মক্কার মুশরিক আবদুল্লাহ ইবনে আরিকতের সাহায্য নিয়েছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) যুদ্ধেও ইহুদিদের সাহায্য নিয়েছেন এবং হুনাইন যুদ্ধে ছওয়ান ইবনে উমাইয়া মুশরিক হওয়া সত্ত্বেও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গী হয়ে যুদ্ধ করেছেন। আল-কোরআনে এক মুসলমানকে অন্য মুসলমানের বন্ধুরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে: ‘মুমিন নর ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু, এরা সৎকার্যের নির্দেশ দেয় এবং অসৎকার্যের নিষেধ করে, সালাত কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে; এদের আল্লাহ কৃপা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা-৯ তাওবাহ, আয়াত: ৭১)। নবী করিম (সা.) মুসলিম উম্মাহকে একটি মানবদেহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই উম্মাহকে একটি প্রাসাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যার এক অংশ অন্য অংশকে শক্তিশালী করে তোলে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘প্রত্যেক মুসলমান একে অন্যের ভাই, কেউ কারও ক্ষতি করে না বা অন্যের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।’ (বোখারী)।
ইসলাম শত্রুর সঙ্গেও ইনসাফপূর্ণ আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। এ ব্যাপারে আল-কোরআনে বলা হয়েছে: ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে; কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদিগকে যেন কখনো সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। সুবিচার করবে, ইহা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করবে। তোমরা যা করো, নিশ্চয় আল্লাহ তার সম্যক খবর রাখেন।’ (সূরা-৫ মায়িদাহ, আয়াত: ৮)। রাসুলুল্লাহ (সা.) পরম শত্রুর সঙ্গেও ভালো আচরণ করেছেন। এ ছাড়া তিনি অমুসলিমদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলতেন। তিনি তাদের সঙ্গে লেনদেন করেছেন এবং শ্রমের বিনিময়ও করেছেন।
পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করা ইসলাম-সমর্থিত নয়। মহান আল্লাহ বলেন: ‘যখন সে প্রস্থান করে তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টির এবং শস্যক্ষেত্র ও জীবজন্তু নিপাতের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ অশান্তি পছন্দ করেন না।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ২০৫)। মহান আল্লাহ আরও বলেন: ‘দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর তোমরা তাতে বিপর্যয় ঘটিয়ো না, তাঁকে ভয় ও আশার সহিত ডাকবে। নিশ্চয় আল্লাহর অনুগ্রহ সৎকর্মপরায়ণদের নিকটবর্তী।’ (সূরা-৭ আরাফ, আয়াত: ৫৬)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে কাসির (র.) বলেন, যেসব কর্মকাণ্ড পৃথিবীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তা করতে আল্লাহ তাআলা নিষেধ করেছেন। কেননা, যখন কাজকর্ম শান্ত পরিবেশে চলতে থাকে, তখন যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, তবে তা হবে বান্দাহদের জন্য বেশি ক্ষতিকর। কোরআন শরিফে রয়েছে: ‘পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করো না।’ (সূরা-২ আল-বাকারা, আয়াত: ১১)।
যুদ্ধ নয়, শান্তিই ইসলামের পরম আরাধ্য। ইসলাম কথায় কথায় যুদ্ধের অনুমতি দেয় না। যেসব ক্ষেত্রে যুদ্ধের অনুমতি রয়েছে, তার উদ্দেশ্যও শান্তি প্রতিষ্ঠা। সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতিসংক্রান্ত আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে: ‘সুতরাং তারা যদি তোমাদের নিকট হতে সরে দাঁড়ায়, তোমাদের সহিত যুদ্ধ না করে এবং তোমাদের নিকট শান্তির প্রস্তাব করে, তবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা অবলম্বনের পথ রাখেন না।’ (সূরা-৪ নিসা, আয়াত: ৯০)।
ইসলাম যুদ্ধাবস্থায়ও শিষ্টাচার ও মানবিকতা অক্ষুণ্ন রাখে। ইসলামে যেসব ক্ষেত্রে যুদ্ধের অনুমতি রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের নির্দেশ দেয়। ইসলাম অতর্কিতভাবে কখনো কারও ওপর আক্রমণ চালানোর অনুমতি দেয় না। ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.) সিরিয়ায় সৈন্যবাহিনী পাঠানোর সময় তাদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন: নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের হত্যা করবে না, লাশ বিকৃত করবে না, সাধু-সন্ন্যাসী ও তপস্বীদের কষ্ট দেবে না; কোনো উপাসনালয় ভাঙচুর করবে না। পশুসম্পদ, ফলবান বৃক্ষ ও ফসলের ক্ষতি করবে না; প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে না। যারা আনুগত্য স্বীকার বা আত্মসমর্পণ করবে, তাদের জানমালকে মুসলমানদের জানমালের মতো নিরাপত্তা দেবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন