শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৫

সৃজনশীলতার চেতনা......

দেশে এখন সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদান করা হচ্ছে, এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে এর উল্টোটাই ঘটছে। আবার এ পদ্ধতিতে গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীলতা কমার কথা থাকলেও বৈপরীত্যমূলক ব্যাপার হচ্ছে, গাইডের ওপর নির্ভরশীলতা আরও বেড়েছে। এ ব্যাপারে অভিভাবকেরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই লেখায় হাত দেওয়া।
জাতিসংঘের ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটসের ২৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘সবারই শিক্ষা লাভের অধিকার আছে।’ মানবিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষার বিকল্প নেই। আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে না পারলে আমরা বিশ্বায়িত পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারব না। এ লক্ষ্যেই সৃজনশীল পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়েছে।
সৃজনশীল পদ্ধতির মাজেজা হচ্ছে শিক্ষণ, পরীক্ষা নয়। এ পদ্ধতির লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করার মতো নিদারুণ ও নিষ্ফলা পরিশ্রমের হাত থেকে রেহাই দেওয়া। ফলে এ পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে সেটা তেমন জনপ্রিয় হচ্ছে না। তার কারণ হলো, সেটা করার জন্য আমাদের যে প্রস্তুতি প্রয়োজন, আমরা সেটা নিতে পারিনি। এই পদ্ধতিতে শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হওয়ার কথা। কিন্তু সে ব্যবস্থা করা আমাদের দেশে কবে সম্ভব হবে, তা বলা মুশকিল। ফলে এখনো পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
সৃজনশীল প্রশ্নকে চারটি অংশে ভাগ করা হয়েছে: জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা। এই চারটি অংশের উত্তর থেকে ছাত্রছাত্রীদের স্মৃতিশক্তি ও চিন্তাক্ষমতার বিভিন্ন স্তর যাচাই করা সম্ভব। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাইয়ীদের মতে, ‘প্রশ্নের চতুর্থ অংশে যাচাই করে দেখা হয় ওই অংশের সঙ্গে সম্পর্কিত পাঠ্যবইয়ের জায়গাটুকু ও উদ্দীপকের ভেতরকার ভাবনাচিন্তা, অনুভূতি-কল্পনাশক্তি, গভীরতা-ব্যাপকতা ইত্যাদিকে ছাত্রছাত্রীরা তুলনা করে বুঝতে পারছে কি না; এদের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য, উচিত-অনুচিত, ভালো-মন্দ ইত্যাদি বিচার-বিবেচনা করে তার নিজস্ব মতামত গড়ে তুলতে পারছে কি না।’
ইংরেজি আমাদের মাতৃভাষা নয়, বিদেশি ভাষা। প্রাথমিক স্তরে বিদেশি ভাষা শেখানোর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু, সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। ফলে ইংরেজির সৃজনশীল প্রশ্ন কেমন হবে, তা নিয়ে আমাদের বিস্তর চিন্তার অবকাশ আছে। কিন্তু সেটা না করে সমাপনীর নম্বর বিন্যাস করা হয়েছে এভাবে: সিন ৫০, আনসিন ৫০। ভাবখানা এমন, যেন ইংরেজি আমাদের মাতৃভাষা। রাজধানী বা বড় শহরের সচ্ছল বাবা-মায়ের সন্তানেরা ভালো স্কুলে পড়ে, সেখানে ভালো শিক্ষকও আছেন। আবার তাদের প্রাইভেট টিউটরও আছে। ফলে তারা হয়তো এই ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে, কিন্তু মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলের গরিব মানুষের সন্তানদের কী হবে, সেটা কি আমরা ভেবে দেখেছি? প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভাষ্য হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের কাছে ইংরেজি আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে অনেক শিক্ষকই বলছেন, গণিত ও ইংরেজিকে সৃজনশীল পদ্ধতির বাইরে রাখা উচিত। কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো, এত কিছুর পরও কিন্তু পরীক্ষার ফল খারাপ হচ্ছে না। তার মানে কি ভূতটা সর্ষেতেই আছে?
আবার কমিউনিকেটিভ ইংরেজির নামে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ব্যাকরণ পড়ানো হচ্ছে না, এমনকি সাহিত্যও নয়। সাহিত্য না পড়লে কি ভাষা শেখা সম্ভব?
প্রাথমিক শিক্ষার হার বেড়েছে—শুধু এ নিয়ে আমাদের এখন আর গর্ব করার অবকাশ নেই। সময় এসেছে, সামনে এগোতে হবে, শিক্ষার মানোন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে, শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি ও যুক্তিবোধ শাণিত করতে হবে
সমস্যা হচ্ছে, সৃজনশীল পদ্ধতি প্রয়োগ করার আগে আমাদের যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া দরকার ছিল, সেটা আমরা নিতে পারিনি। সব শিক্ষককে এখন পর্যন্ত প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। আবার যাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাঁরা যে প্রশিক্ষণলব্ধ শিক্ষা শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগ করছেন, সেটাই বা কে দেখছে। আগের পদ্ধতির সঙ্গে যে এ পদ্ধতির মৌলিক তফাত রয়েছে, সেটা ভুলে গেলে চলবে না। সৃজনশীলের মূল কথা হচ্ছে শিক্ষণ। ফলে পুরো প্রস্তুতি না নিয়ে হুট করে এই পদ্ধতি চালু করে দেওয়া কতটা যৌক্তিক, সে প্রশ্ন তোলার সময় হয়েছে।
মোদ্দা কথা হলো, সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশি সৃজনশীল হতে হবে। সেটা নিশ্চিত না করে এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে তো হবে না। শিক্ষকেরা যাতে সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্ন নিজে প্রণয়ন করতে পারেন, সে লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেছে। আবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, বাজার অথবা গাইড থেকে নমুনা প্রশ্ন নিয়ে পাবলিক কিংবা স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার প্রশ্ন করা যাবে না। অথচ খোদ এসএসসি পরীক্ষাতেই গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দেওয়া হয়েছে। প্রয়োগের এই ঘাটতির কারণে গাইড বই ও কোচিং সেন্টারের আরও বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। তার চেয়েও বড় চিন্তার কারণ হচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁস। অভিযোগ উঠেছে, এই ফাঁসের সঙ্গে কোচিং সেন্টারগুলো জড়িত। ওদিকে ভালো ছাত্রদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করার মতো সরকার তো কিছু করছেই না, উল্টো অষ্টম পে–স্কেলে সরকার শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করেছে।
আরেকটি ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। একদিকে আমরা শিক্ষণকে মূল মন্ত্র বলব, আরেক দিকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অযাচিত পরীক্ষার চাপে ফেলব, তা হতে পারে না। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার কথা ছিল না, কিন্তু আমরা তাতে কর্ণপাত না করে শিক্ষার্থীদের জীবনে আরেকটি পাবলিক পরীক্ষা যোগ করেছি, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সারা দিন দৌড়ের ওপর রাখার ব্যবস্থা করেছি। তবে এতে আর কেউ লাভবান না হলেও কোচিং সেন্টারগুলো লাভবান হচ্ছে; কারণ স্কুলে পড়াশোনা হয় না, তাই কোচিং সেন্টারে না গেলে পড়া হবে কী করে? অনেক বাবা-মায়েরই তো পড়ানোর সময় নেই। এই অযাচিত চাপে পড়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে, সেটা কি আমরা ভেবে দেখছি? তবে আশার কথা হচ্ছে, শিক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, ২০১৮ সাল থেকে প্রাথমিক সমাপণী পরীক্ষা থাকবে না। মন্ত্রীর এ বক্তব্য যেন কথার কথা না হয়।
প্রাথমিক শিক্ষার হার বেড়েছে—শুধু এ নিয়ে আমাদের এখন আর গর্ব করার অবকাশ নেই। সময় এসেছে, সামনে এগোতে হবে, শিক্ষার মানোন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে, শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি ও যুক্তিবোধ শাণিত করতে হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত আজ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সিইও সরবরাহকারী দেশ। অর্থাৎ পৃথিবীর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে যাঁরা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও হিসেবে কাজ করছেন, তাঁদের সিংহভাগই ভারতীয়। আর আমরা এখনো বিদেশে শ্রমশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে শুধু সংখ্যা নিয়ে গর্ব করছি। আবার সেই শ্রমিকেরা ইংরেজি না জানার কারণে বিদেশে নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই হচ্ছে আমাদের শিক্ষার হাল!
তবে এত কিছু বলার মানে কিন্তু এই নয় যে সৃজনশীল পদ্ধতি বাদ দিতে হবে। কথা হচ্ছে, সৃজনশীল পদ্ধতিকে আরও কার্যকর করার জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে, স্ববিরোধগুলো দূর করতে হবে।

ইসলাম এসেছে শান্তি নিয়ে........

ইসলামের উদ্দেশ্য ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি। ইসলামি জীবনাদর্শ বিশ্বের সব মানুষের জন্য। ইসলামের লক্ষ্য হলো মানুষের সমাজে শান্তি, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ ও মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা। ইসলামি বিধিবিধানের মূল লক্ষ্য মানুষের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং যাবতীয় অকল্যাণ ও ক্ষতিকর দিক থেকে মানবসমাজকে রক্ষা করা।
মানুষের জানমাল ও ইজ্জত-আব্রুর হেফাজত করার নাম ইসলাম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতএব, তারা ইবাদত করুক এই গৃহের মালিকের, যিনি তাহাদিগকে ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং ভীতি হইতে তাহাদিগকে নিরাপদ করেছেন।’ (সূরা-১০৬ কুরাইশ, আয়াত: ৩-৪)। অর্থাৎ তাদের উচিত বায়তুল্লাহ তথা কাবা শরিফের রবের ইবাদত-বন্দেগি করা, যিনি ক্ষুধা ও ভয়ভীতি থেকে নিরাপত্তা বিধান করেছেন। এতে বোঝা যায়, ইসলামি আদর্শই মানুষের মৌলিক চাহিদা ও মৌলিক অধিকারের একমাত্র রক্ষাকবচ। মানুষ দুনিয়ার জীবনে বেঁচে থাকার তাগিদে চায় সব ধরনের ভয়ভীতি থেকে তার জানমাল, ইজ্জত-আব্রু হেফাজতের নিশ্চয়তা। ইসলামি জীবনব্যবস্থার প্রতিটি দিক ও বিভাগেই রয়েছে মানুষের সব অধিকারের বাস্তব প্রতিফলন। নবী-রাসুলের আগমন এবং আসমানি কিতাবের মূল লক্ষ্য মানুষের সমাজে প্রকৃত শান্তি, কল্যাণ ও ইনসাফ নিশ্চিত করা। সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন এবং সর্বশেষ কিতাব আল-কোরআন নাজিলের চূড়ান্ত লক্ষ্য এটাই। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এর মূল লক্ষ্য।
ইমান আনার ব্যাপারে বলপ্রয়োগ প্রযোজ্য নয়। ইমান বা বিশ্বাস ইসলামি আদর্শ ও জীবনব্যবস্থার ভিত্তি। এই ইমান আনার ক্ষেত্রে ইসলামে বলপ্রয়োগের বা জবরদস্তির কোনো সুযোগ নেই। মানুষের কাছে সত্য ও মিথ্যার, ন্যায় ও অন্যায়ের, হেদায়েত ও গোমরাহির বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে তুলে ধরা ছিল নবী-রাসুলগণের দায়িত্ব। ইমান আনা না-আনার বিষয়টি মানুষের বিবেক, বুদ্ধি ও ইচ্ছার ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন: ‘দীন সম্পর্কে জোর-জবরদস্তি নেই; সত্য পথ ভ্রান্ত হতে সুস্পষ্ট হয়েছে। যে তাগুতকে অস্বীকার করবে, আল্লাহে ইমান আনবে, সে এমন এক মজবুত হাতল ধরবে, যা কখনো ভাঙবে না। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৫৬)। আল্লাহ তাআলা অন্যত্র ঘোষণা করেছেন: ‘বলো, সত্য তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে; সুতরাং যার ইচ্ছা বিশ্বাস করুক ও যার ইচ্ছা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করুক।’ (সূরা-১৮ কাহাফ, আয়াত: ২৯)।
বিশ্বময় চিরস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম মানবভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সে সমগ্র মানবজাতিকে একই পরিবারভুক্ত মনে করে। ইসলামের কথা হচ্ছে, সব মানুষই এক আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি এবং তিনি সমগ্র বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও প্রতিপালক। তিনি প্রত্যেক মানুষকেই মানবীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টির সেরা করেছেন। ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, সব মানুষের উৎপত্তি এক আদম ও হাওয়া থেকে। ইসলাম আরও শিক্ষা দেয়, হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে পরবর্তী সব নবী-রাসুল যেমন: হজরত নূহ (আ.), হজরত ইব্রাহিম (আ.), হজরত মুসা (আ.), হজরত ঈসা (আ.), হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রত্যেকেই ছিলেন ভাই ভাই এবং তাঁদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মহান আল্লাহ বলেন: ‘তোমরা বলো, আমরা আল্লাহতে ইমান রাখি এবং যা আমাদের প্রতি, ইব্রাহিম (আ.), ইসমাইল (আ.), ইসহাক (আ.), ইয়াকুব (আ.) ও তাঁর বংশধরগণের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা তাঁদের প্রতিপালকের নিকট থেকে মূসা (আ.), ইসা (আ.) ও অন্যান্য নবীকে দেওয়া হয়েছে। আমরা তাঁদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না এবং আমরা তাঁরই নিকট আত্মসমর্পণকারী।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৩৬)। মহান আল্লাহ আরও বলেন: ‘মানুষ ছিল একই উম্মত, পরে তারা মতভেদ সৃষ্টি করে। তোমার প্রতিপালকের পূর্বঘোষণা না থাকলে তারা যে বিষয়ে মতভেদ ঘটায়, তার মীমাংসা তো হয়েই যেত।’ (সূরা-১০ ইউনুস, আয়াত: ১৯)।
ইসলাম সব জাতির সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। ইসলাম সবার সঙ্গে ন্যায়পরতা, সুবিচার ও সুন্দর আচরণ করার শিক্ষা দেয়। ইসলামি শরিয়াহ বিশ্বব্যাপী মানবভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে যুদ্ধ সংঘটনের কারণ দূর করতে চায়। ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, শিল্প, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানবভ্রাতৃত্বের নীতিতে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার মধ্যে সহযোগিতামূলক সুসম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হলে যুদ্ধের আশঙ্কা কমে যায়। মানবভ্রাতৃত্বের পাশাপাশি ইসলাম বিশ্বাসের ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চায়। হিজরতের সময় পথ দেখানোর জন্য তিনি মক্কার মুশরিক আবদুল্লাহ ইবনে আরিকতের সাহায্য নিয়েছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) যুদ্ধেও ইহুদিদের সাহায্য নিয়েছেন এবং হুনাইন যুদ্ধে ছওয়ান ইবনে উমাইয়া মুশরিক হওয়া সত্ত্বেও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গী হয়ে যুদ্ধ করেছেন। আল-কোরআনে এক মুসলমানকে অন্য মুসলমানের বন্ধুরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে: ‘মুমিন নর ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু, এরা সৎকার্যের নির্দেশ দেয় এবং অসৎকার্যের নিষেধ করে, সালাত কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে; এদের আল্লাহ কৃপা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা-৯ তাওবাহ, আয়াত: ৭১)। নবী করিম (সা.) মুসলিম উম্মাহকে একটি মানবদেহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই উম্মাহকে একটি প্রাসাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যার এক অংশ অন্য অংশকে শক্তিশালী করে তোলে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘প্রত্যেক মুসলমান একে অন্যের ভাই, কেউ কারও ক্ষতি করে না বা অন্যের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।’ (বোখারী)।
ইসলাম শত্রুর সঙ্গেও ইনসাফপূর্ণ আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। এ ব্যাপারে আল-কোরআনে বলা হয়েছে: ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে; কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদিগকে যেন কখনো সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। সুবিচার করবে, ইহা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করবে। তোমরা যা করো, নিশ্চয় আল্লাহ তার সম্যক খবর রাখেন।’ (সূরা-৫ মায়িদাহ, আয়াত: ৮)। রাসুলুল্লাহ (সা.) পরম শত্রুর সঙ্গেও ভালো আচরণ করেছেন। এ ছাড়া তিনি অমুসলিমদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলতেন। তিনি তাদের সঙ্গে লেনদেন করেছেন এবং শ্রমের বিনিময়ও করেছেন।
পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করা ইসলাম-সমর্থিত নয়। মহান আল্লাহ বলেন: ‘যখন সে প্রস্থান করে তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টির এবং শস্যক্ষেত্র ও জীবজন্তু নিপাতের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ অশান্তি পছন্দ করেন না।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ২০৫)। মহান আল্লাহ আরও বলেন: ‘দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর তোমরা তাতে বিপর্যয় ঘটিয়ো না, তাঁকে ভয় ও আশার সহিত ডাকবে। নিশ্চয় আল্লাহর অনুগ্রহ সৎকর্মপরায়ণদের নিকটবর্তী।’ (সূরা-৭ আরাফ, আয়াত: ৫৬)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে কাসির (র.) বলেন, যেসব কর্মকাণ্ড পৃথিবীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তা করতে আল্লাহ তাআলা নিষেধ করেছেন। কেননা, যখন কাজকর্ম শান্ত পরিবেশে চলতে থাকে, তখন যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, তবে তা হবে বান্দাহদের জন্য বেশি ক্ষতিকর। কোরআন শরিফে রয়েছে: ‘পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করো না।’ (সূরা-২ আল-বাকারা, আয়াত: ১১)।
যুদ্ধ নয়, শান্তিই ইসলামের পরম আরাধ্য। ইসলাম কথায় কথায় যুদ্ধের অনুমতি দেয় না। যেসব ক্ষেত্রে যুদ্ধের অনুমতি রয়েছে, তার উদ্দেশ্যও শান্তি প্রতিষ্ঠা। সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতিসংক্রান্ত আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে: ‘সুতরাং তারা যদি তোমাদের নিকট হতে সরে দাঁড়ায়, তোমাদের সহিত যুদ্ধ না করে এবং তোমাদের নিকট শান্তির প্রস্তাব করে, তবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা অবলম্বনের পথ রাখেন না।’ (সূরা-৪ নিসা, আয়াত: ৯০)।
ইসলাম যুদ্ধাবস্থায়ও শিষ্টাচার ও মানবিকতা অক্ষুণ্ন রাখে। ইসলামে যেসব ক্ষেত্রে যুদ্ধের অনুমতি রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের নির্দেশ দেয়। ইসলাম অতর্কিতভাবে কখনো কারও ওপর আক্রমণ চালানোর অনুমতি দেয় না। ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.) সিরিয়ায় সৈন্যবাহিনী পাঠানোর সময় তাদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন: নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের হত্যা করবে না, লাশ বিকৃত করবে না, সাধু-সন্ন্যাসী ও তপস্বীদের কষ্ট দেবে না; কোনো উপাসনালয় ভাঙচুর করবে না। পশুসম্পদ, ফলবান বৃক্ষ ও ফসলের ক্ষতি করবে না; প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে না। যারা আনুগত্য স্বীকার বা আত্মসমর্পণ করবে, তাদের জানমালকে মুসলমানদের জানমালের মতো নিরাপত্তা দেবে।